অধ্যায় ৫১: মালতী দেবীর অন্তিম ইচ্ছা ও কঠিন সংকল্প
সেই ঝড়ের রাতের পর চৌধুরী বাড়িতে এক অদ্ভুত, থমথমে শান্তি বিরাজ করছিল। কিন্তু এই শান্তির আড়ালে ছিল তিনটে মানুষের মনের উত্তাল সমুদ্র। মহেন্দ্র এবং রিয়া, তাদের নিষিদ্ধ ভালোবাসা আর তীব্র শারীরিক আকর্ষণের মধ্যে ভাসছিল। আর মালতী দেবী, তার শারীরিক যন্ত্রণার থেকেও বেশি, মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছিলেন। তিনি তার মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছিলেন এবং তার আগে তাকে তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিতেই হবে।
একদিন সকালে, যখন রিয়া আদিত্যকে তেল মাখিয়ে স্নান করানোর জন্য নিয়ে গেছে, মালতী দেবী মহেন্দ্রবাবুকে তার ঘরে ডাকলেন। তার গলার স্বরটা ছিল শান্ত, কিন্তু অসম্ভব দৃঢ়। মহেন্দ্রবাবু তার স্ত্রীর পাশে এসে বসতেই, মালতী দেবী তার হাতটা নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিলেন। "আমার একটা কথা শুনবে? আমার শেষ ইচ্ছা হিসেবে?" মহেন্দ্রবাবু চমকে উঠলেন। "এমনভাবে কেন বলছ মালতী? তোমার কিচ্ছু হবে না। ডাক্তার বলেছে তুমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে।" "ডাক্তার শরীরের কথা বলে, মনের কথা নয়," মালতী দেবী মৃদু হাসলেন। "আমি আমার শরীরটাকে চিনি। আমার সময় ফুরিয়ে আসছে। কিন্তু আমি শান্তিতে মরতে চাই। আর তার জন্য তোমাকে আমার একটা কথা রাখতে হবে।"
মহেন্দ্রবাবু তার স্ত্রীর চোখের দিকে তাকালেন। সেই চোখে ছিল এক অদম্য জেদ। "বলো, কী করতে হবে?" "আমরা আর এই গ্রামে থাকব না," মালতী দেবী শান্তভাবে বললেন। "আমরা সবাই কলকাতায় থাকব। তুমি কলকাতায় একটা বড় বাড়ি কেনো। বাগানওয়ালা, সুন্দর একটা বাংলো। যেখানে আমরা সবাই একসাথে থাকতে পারি।" মহেন্দ্রবাবু অবাক হলেন। "হঠাৎ কলকাতার কথা বলছ কেন? আমাদের এই বাড়ি, এই জমিদারি, এসব ছেড়ে..." "সব ম্যানেজার দেখবে," মালতী দেবী তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন। "তোমার সারাজীবন অনেক পরিশ্রম করেছ। এবার তোমার বিশ্রাম নেওয়ার সময়। তোমার ভালোবাসার মানুষের সাথে, তোমার ছেলের সাথে সময় কাটানোর সময়।"
'ভালোবাসার মানুষ' এবং 'ছেলে'—এই দুটো শব্দ মহেন্দ্রবাবুর বুকে তীরের মতো বিঁধল। তিনি বুঝতে পারছিলেন, মালতী দেবী কোনদিকে ইঙ্গিত করছেন। "মালতী, তুমি যা ভাবছ, তা সম্ভব নয়। তুমি বেঁচে থাকতে..." "আমি বেঁচে থাকতে থাকতেই আমি এটা দেখে যেতে চাই," মালতী দেবীর গলাটা কেঁপে উঠল। "আমি নিজের চোখে আমার স্বামীর সংসার গুছিয়ে দিয়ে যেতে চাই। আমি জানি, তুমি রিয়াকে ভালোবাসো। আর রিয়াও তোমাকে ভালোবাসে। তোমাদের এই সম্পর্কটা কোনো পাপ নয়। এটা ঈশ্বরের ইচ্ছা। আমি চাই, তোমরা বিয়ে করো।"
"বিয়ে?" মহেন্দ্রবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। "তুমি বলছটা কী? আমি আমার নিজের পূত্রবধূর সাথে... সমাজ কী বলবে? অনি... অনির কী হবে?" "সমাজের কথা আমি ভাবব," মালতী দেবী বললেন। "আর অনির কথাও আমি ভেবেছি। কিন্তু তার আগে, তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি আমার এই ইচ্ছাটা পূরণ করবে। আমি মরার আগে রিয়াকে এই বাড়ির 'বড় বৌমা' হিসেবে, তোমার স্ত্রী হিসেবে দেখে যেতে চাই। এটাই আমার জীবনের শেষ ইচ্ছা। দেবে না আমাকে এই শান্তিটুকু?"
মালতী দেবীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। তার এই কান্নামাখা, দৃঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে মহেন্দ্র চৌধুরীর মতো কঠিন মানুষটাও গলে গেলেন। তার এতদিনের সংযম, তার বিবেক, তার সামাজিক লজ্জা—সবকিছু তার স্ত্রীর ভালোবাসার কাছে, তার এই চরম ত্যাগের কাছে হার মানল। তিনি তার স্ত্রীর হাতটা নিজের চোখের ওপর চেপে ধরলেন। তার চোখ দিয়েও জল পড়ছিল। "তুমি যা বলবে, তাই হবে মালতী," তিনি ধরা গলায় বললেন। "তোমার ইচ্ছাই আমার কাছে আদেশ।"
অধ্যায় ৫২: নতুন ঠিকানা ও ভালোবাসার স্বীকৃতি
মালতী দেবীর সিদ্ধান্তই এখন চৌধুরী বাড়ির আইন। তার ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার জন্য মহেন্দ্রবাবু উঠেপড়ে লাগলেন। তিনি কলকাতায় তার এক পুরনো বন্ধু, যিনি রিয়েল এস্টেটের ব্যবসায় আছেন, তাকে ফোন করলেন। তার নির্দেশ ছিল স্পষ্ট—এক সপ্তাহের মধ্যে কলকাতার সবচেয়ে অভিজাত এলাকায় একটা বড়, বাগানওয়ালা বাংলো চাই। টাকার কোনো চিন্তা নেই।
গ্রামের পরিচালনার ভার তিনি তার বিশ্বস্ত ম্যানেজারের হাতে তুলে দিলেন। তাকে বুঝিয়ে দিলেন, এখন থেকে তিনিই সবকিছু দেখবেন। চৌধুরী বাড়ির সমস্ত সম্পত্তি, সমস্ত ব্যবসা, এখন থেকে তারই দায়িত্বে।
এরপরের কাজটা ছিল রিয়াকে জানানো। সেদিন বিকেলে, মালতী দেবী রিয়াকে তার ঘরে ডাকলেন। মহেন্দ্রবাবুও সেখানে ছিলেন। রিয়া ঘরে ঢুকতেই মালতী দেবী তার হাতটা ধরে নিজের পাশে বসালেন। "বৌমা, আমি আর তোর শ্বশুর একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি," তিনি শান্তভাবে বললেন। রিয়া অবাক হয়ে তাদের দুজনের মুখের দিকে তাকাতে লাগল। "আমরা সবাই পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে যাচ্ছি। তোর শ্বশুর ওখানে একটা নতুন বাড়ি কিনছে।" রিয়া বিস্ময়ে হতবাক। "আর... আর আমি চাই, তুই আর তোর শ্বশুর বিয়ে কর," মালতী দেবী রিয়ার মাথায় হাত রেখে বললেন।
রিয়ার মনে হলো, তার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। বিয়ে? তার শ্বশুরের সাথে? এও কি সম্ভব? "মা... আপনি... আপনি কী বলছেন এসব?" তার গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছিল না। "আমি ঠিকই বলছি," মালতী দেবী বললেন। "আমি জানি, তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস। আমি চাই, তোদের এই ভালোবাসার সম্পর্কটা সামাজিক স্বীকৃতি পাক। আমি তোকে আর কোনোদিনও এক রক্ষিতার পরিচয়ে বাঁচতে দেখতে চাই না। তুই হবি এই বাড়ির বড় বৌমা, আমার স্বামীর স্ত্রী, আর আদিত্য পাবে তার আসল বাবার পরিচয়।"
রিয়া মহেন্দ্রবাবুর দিকে তাকাল। মহেন্দ্রবাবুর চোখে ছিল সম্মতি আর গভীর ভালোবাসা। রিয়া বুঝতে পারছিল, এটা শুধু মালতী দেবীর ইচ্ছা নয়, এটা মহেন্দ্রবাবুরও মনের কথা। রিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তার জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্নটা, যা সে কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি, তা আজ সত্যি হতে চলেছে। সে তার ভালোবাসার মানুষকে সম্পূর্ণভাবে পাবে। সে আর গোপন প্রেমিকা নয়, সে হবে তার প্রেমিকের স্ত্রী। সে মালতী দেবীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। "আপনি যা বলবেন, তাই হবে মা," সে কাঁদতে কাঁদতে বলল।
অধ্যায় ৫৩: পুত্রের প্রতি নির্দেশ ও পরিচয়ের অবলুপ্তি
সবচেয়ে কঠিন কাজটা তখনও বাকি ছিল। অনির্বাণকে জানানো। এই দায়িত্বটাও মালতী দেবী নিজের কাঁধেই তুলে নিলেন। তিনি জানতেন, মহেন্দ্রবাবু বা রিয়া কেউই এই কথাটা অনির্বাণকে বলতে পারবে না।
তিনি অনির্বাণকে ফোন করলেন। "অনি, একটা জরুরি কথা ছিল," তার গলাটা ছিল শান্ত, কিন্তু বরফের মতো ঠান্ডা। "বলো মা," অনির্বাণের গলায় উদ্বেগ। "আমরা সবাই কলকাতা ফিরে আসছি। পাকাপাকিভাবে। তোর বাবা আলিপুরে একটা নতুন বাংলো কিনেছে। আমরা আগামী সপ্তাহেই সেখানে উঠব।" অনির্বাণ অবাক হলো। "হঠাৎ? আর গ্রামের সব?" "সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তুই ওসব নিয়ে চিন্তা করিস না।"
মালতী দেবী এক মুহূর্ত থামলেন। তারপর তার সেই চূড়ান্ত আঘাতটা হানলেন। "আমরা গ্রাম থেকে কলকাতা যাওয়ার পথে, তারাপীঠের মন্দিরে থামব। সেখানে তোর বাবা আর রিয়ার বিয়ে হবে।" ফোনের ওপারে অনির্বাণ স্তব্ধ। তার মনে হলো, তার কানে তালা লেগে গেছে। সে ঠিক শুনছে তো? "মা... তুমি... তুমি কী বলছ?" "যা সত্যি, তাই বলছি," মালতী দেবীর গলায় কোনো আবেগের লেশমাত্র নেই। "আমি মরার আগে ওদের দুজনকে এক দেখে যেতে চাই। এটাই আমার শেষ ইচ্ছা।"
অনির্বাণ কিছু বলার আগেই, মালতী দেবী তার শেষ নির্দেশটা দিলেন। "আর একটা কথা। মন দিয়ে শোন। আজ থেকে রিয়া আর তোর স্ত্রী নয়। সে তোর বাবার স্ত্রী। অর্থাৎ, সম্পর্কে সে তোর মা। তুই আজ থেকে ওকে 'মা' বলে ডাকবি। এটাই তোর প্রায়শ্চিত্ত, আর এটাই তোর বাবার আর তোর নতুন মায়ের প্রতি তোর কর্তব্য। এর অন্যথা হলে, চৌধুরী বাড়ির সম্পত্তিতে তোর কোনো অধিকার থাকবে না। মনে রাখিস।"
ফোনটা কেটে গেল। অনির্বাণ তার বালিগঞ্জের সেই শূন্য ফ্ল্যাটে, সোফার ওপর বসে রইল। তার হাতে ধরা মোবাইল ফোনটা। তার পৃথিবীটা যেন চুরমার হয়ে গেছে। তার মা তাকে কী নির্দেশ দিয়ে গেলেন! তার নিজের স্ত্রীকে, যার শরীরের প্রতিটি ভাঁজ তার পরিচিত, তাকে আজ থেকে 'মা' বলে ডাকতে হবে? এর থেকে বড় অপমান, এর থেকে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে?
তার ভেতরের পুরুষসত্তাটা শেষবারের মতো বিদ্রোহ করার চেষ্টা করল। কিন্তু সে জানে, এই বিদ্রোহ অর্থহীন। সে একজন পরাজিত সৈনিক। তার আর কোনো পরিচয় নেই, কোনো অস্তিত্ব নেই।
তার মা তাকে তার নতুন পরিচয় দিয়ে গেছেন। সে এখন আর স্বামী নয়, সে শুধু একজন পুত্র। তার নিজের স্ত্রীর পুত্র। অনির্বাণ শূন্য দৃষ্টিতে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। তার ঠোঁট দুটো সামান্য কেঁপে উঠল। তারপর, তার মুখ দিয়ে একটা অস্ফুট, ভাঙা শব্দ বেরিয়ে এল, যা সে নিজেই শুনতে পেল না। "...মা?"
তার পরিচয়ের আজ সলিল সমাধি ঘটল। চৌধুরী বংশের নতুন অধ্যায় শুরু হওয়ার জন্য, তার পুরনো অধ্যায়টাকে এভাবেই শেষ হয়ে যেতে হলো।
অধ্যায় ৫৪: পথের মন্দিরে পরিণয়
যাওয়ার দিনটা এসে গেল। চৌধুরী বাড়ির বিশাল উঠোনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মালপত্র তোলা হচ্ছে। গ্রামের কয়েকজন বিশ্বস্ত কর্মচারী ছলছল চোখে দাঁড়িয়ে আছে তাদের মনিবকে বিদায় জানানোর জন্য।
গাড়িতে ওঠার সময় এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি হলো। অনির্বাণ গিয়ে বসল ড্রাইভারের পাশের সামনের সিটে, যেন সে এই পরিবারের ড্রাইভার বা একজন সাধারণ সঙ্গী। আর পেছনের প্রশস্ত সিটে, একপাশে জানালার ধারে বসলেন মহেন্দ্রবাবু, তার কোলে ছোট্ট আদিত্য। অন্যপাশে বসলেন মালতী দেবী, আর তাদের দুজনের মাঝখানে রিয়া। যেন এটাই তাদের আসল পরিবার। এক সম্পূর্ণ, সুখী পরিবারের ছবি।
গাড়ি চলতে শুরু করল। গ্রামের চেনা পথ, সবুজ মাঠ, পুকুর—সবকিছু পেছনে ফেলে তারা এগিয়ে চলল এক নতুন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। গাড়ির ভেতরে এক গভীর নিস্তব্ধতা। শুধু আদিত্যর আধো-আধো শব্দ আর গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ। প্রত্যেকেই তার নিজের চিন্তার জগতে ডুবে আছে।
কলকাতা থেকে প্রায় দু-ঘণ্টা আগে, গাড়িটা হঠাৎ মূল রাস্তা ছেড়ে একটা গ্রামের কাঁচা রাস্তায় প্রবেশ করল। অনির্বাণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল, কিন্তু মহেন্দ্রবাবুর ইশারায় সে চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ পর, গাড়িটা এসে থামল এক প্রাচীন, নির্জন মন্দিরের সামনে। এটা তারাপীঠের মূল মন্দির নয়, তার থেকে কিছুটা দূরে, এক শান্ত, নিরিবিলি জায়গায় অবস্থিত এক পুরনো কালী মন্দির।
মালতী দেবী আগে থেকেই সবকিছু ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। মন্দিরের বৃদ্ধ পুরোহিত তাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। "এসে গেছিস মা," পুরোহিত মালতী দেবীকে দেখে বললেন। গাড়ি থেকে নামার পর, মালতী দেবী রিয়াকে তার সাথে মন্দিরের ভেতরে একটা ছোট ঘরে নিয়ে গেলেন। সেখানে রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল একটা লাল বেনারসি শাড়ি, কিছু সোনার গয়না। "এটা পর," মালতী দেবী শান্তভাবে বললেন। "আজ তোর আবার বিয়ে। আজ তুই সত্যিকারের 'বড় বৌমা' হবি।" রিয়া কাঁপা হাতে শাড়িটা তুলে নিল। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল।
কিছুক্ষণ পর, যখন রিয়া লাল বেনারসি পরে, কপালে একটা ছোট্ট টিপ দিয়ে, মাথায় ঘোমটা টেনে মন্দিরের গর্ভগৃহে এসে দাঁড়াল, তখন মহেন্দ্রবাবু তার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না। তার মনে হলো, স্বর্গের দেবী যেন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
ছোট্ট, অনাড়ম্বর এক আয়োজন। পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যে দিয়ে তাদের বিয়ে শুরু হলো।
মহেন্দ্রবাবুর মনের ভেতর: তিনি রিয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আগুনের শিখার আলোয় রিয়ার মুখটা আরও বেশি মায়াবী, আরও বেশি পবিত্র দেখাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল, জীবনের ষাটটা বছর পার করে এসে, তিনি আজ তার সত্যিকারের ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়েছেন। তিনি যখন রিয়ার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছিলেন, তখন তার হাতটা কাঁপছিল। এই সিঁদুর শুধু একটা সামাজিক চিহ্ন নয়, এটা তার অধিকারের ঘোষণা। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, "রিয়া, আজ থেকে তুমি শুধু আমার। তোমার সব দায়িত্ব, তোমার সব সুখ, তোমার সব আনন্দ—সবই আমার। আমি তোমাকে কোনোদিনও কষ্ট পেতে দেব না।"
রিয়ার মনের ভেতর: সে মহেন্দ্রবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। সেই চোখে সে দেখল এক গভীর ভালোবাসা, এক পরম নির্ভরতা। যখন মহেন্দ্রবাবু তার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়ে দিলেন, তখন রিয়ার সারা শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল। তার মনে হলো, তার জীবনের সমস্ত অপূর্ণতা, সমস্ত যন্ত্রণা আজ শেষ হলো। সে আর পরিচয়হীন নয়। সে আর রক্ষিতা নয়। সে আজ মহেন্দ্র চৌধুরীর স্ত্রী। এই পরিচয়টা তাকে এক অদ্ভুত শক্তি, এক নতুন আত্মবিশ্বাস দিল। সে মনে মনে বলল, "আমি শুধু তোমার। আমার এই শরীর, আমার এই মন, আমার আত্মা—সবই আজ থেকে তোমার। তুমিই আমার স্বামী, আমার ঈশ্বর।"
বিয়ে শেষ হলো। তারা যখন মন্দির থেকে বেরিয়ে আসছিল, তখন মালতী দেবীর মুখে ছিল এক শান্ত, তৃপ্তির হাসি। তার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজটা তিনি শেষ করতে পেরেছেন।
অধ্যায় ৫৫: নতুন গৃহ, নতুন পরিচয়
কলকাতার আলিপুরে, এক শান্ত, সবুজ গলির ভেতরে তাদের নতুন বাংলো। বিশাল বাগান, সাদা রঙের দোতলা বাড়ি। গাড়িটা যখন গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল, তখন অনির্বাণ দেখল, বাড়িটা তাদের বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটের থেকে অনেক বড়, অনেক বেশি সুন্দর।
বাড়ির পরিচারকরা আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। মালতী দেবী হুইলচেয়ারে বসেই সব নির্দেশ দিচ্ছিলেন। "আগে আদিত্য আর বড় বৌমাকে তাদের ঘরে নিয়ে যাও," তিনি একজন পুরনো, বিশ্বস্ত পরিচারিকাকে বললেন।
দোতলার সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে সুন্দর ঘরটা সাজানো হয়েছে নবদম্পতির জন্য। ফুল দিয়ে, আলো দিয়ে। খাটের ওপর ফুলের চাদর। এটা তাদের ফুলশয্যার ঘর। মালতী দেবী নিজের হাতে সব ব্যবস্থা করিয়েছেন।
তিনি রিয়ার দিকে তাকালেন। রিয়া তখনও সেই লাল বেনারসি পরে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে, কোলে আদিত্যকে নিয়ে দাঁড়িয়ে। মালতী দেবী অনির্বাণ আর মহেন্দ্রবাবুর সামনেই, শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় রিয়াকে বললেন, "বৌমা, ওটা তোমার আর অনির পুরনো সংসার ছিল। এটা তোমার নতুন সংসার, নতুন ঘর। যাও, তোমার স্বামীর ঘরে যাও। উনি তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।" তিনি হাত দিয়ে মহেন্দ্রবাবুর ঘরের দিকে ইশারা করলেন।
এই কথাগুলো, এই দৃশ্যটা, অনির্বাণের কাছে এক public humiliation-এর মতো ছিল। সে দেখল, তার স্ত্রী, তার রিয়া, এক নববধূর সাজে, তার সন্তানকে কোলে নিয়ে, তার বাবার শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। 'তোমার স্বামী'—এই দুটো শব্দ তার কানের ভেতরে হাতুড়ির মতো আঘাত করছিল।
সে রিয়াকে দেখল, তারপর তার বাবাকে। সে তার জায়গাটা বুঝতে পারল। আজ থেকে সে আর রিয়ার স্বামী নয়। সে এই বাড়ির একজন সাধারণ সদস্য। একজন পুত্র। তার বাবার পুত্র, এবং তার স্ত্রীর... পুত্র। 'ককোল্ড' শব্দটা তার মাথায় আর কোনো অপমান হিসেবে নয়, এক চরম সত্যি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো।
অধ্যায় ৫৬: পুত্রের কর্তব্য ও পরিচয়ের সলিল সমাধি
রিয়া মহেন্দ্রবাবুর ঘরের দরজার সামনে এসে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল। তার পা দুটো যেন আর এগোতে চাইছে না। এই নতুন পরিচয়, এই নতুন সম্পর্ক—সবকিছু তার কাছে এখনও স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে, অনির্বাণ যা করল, তা দেখে বাড়ির সকলেই স্তব্ধ হয়ে গেল। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এল। প্রথমে সে তার বাবার সামনে গিয়ে, মাথা নিচু করে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। মহেন্দ্রবাবু তার ছেলের পিঠে হাত রেখে তাকে আশীর্বাদ করলেন। তার মুখে ছিল এক বিজয়ীর হাসি।
তারপর, অনির্বাণ ঘুরল। সে রিয়ার সামনে এসে দাঁড়াল। রিয়া বিস্ময়ে, আতঙ্কে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু অনির্বাণ তার আগেই, মাথা নিচু করে, তার স্ত্রীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। যে পায়ে সে কোনোদিন ভালোবাসার আলতা পরিয়ে দেয়নি, আজ সেই পায়ে সে রাখল তার সমস্ত অহংকার, তার সমস্ত পুরুষত্ব, তার সমস্ত পরিচয়।
এক পুত্র যেমন তার নতুন মাকে প্রণাম করে, ঠিক সেই ভঙ্গিতে। রিয়া কেঁপে উঠল। তার শ্বাশুড়ির নির্দেশ, আর তার স্বামীর এই চরম আত্মসমর্পণ—সবকিছু মিলে তাকে এক নতুন, শক্তিশালী পরিচয়ে প্রতিষ্ঠিত করে দিল।
অনির্বাণ যখন রিয়ার পা থেকে মাথা তুলল, তখন তার চোখ দুটো ছিল শূন্য, অনুভূতিহীন। সে রিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে, এক ভাঙা, অস্ফুট গলায়, যা শুধু তারা দুজনই শুনতে পেল, বলল, "সুখী হও, মা।"
'মা'—এই একটা শব্দ। এই একটা শব্দে অনির্বাণের পুরনো পরিচয়ের সলিল সমাধি ঘটল। সে আজ থেকে আর রিয়ার স্বামী নয়। সে তার 'মা'-এর সন্তান, আদিত্যর বড় ভাই।
রিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। সে আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। সে আদিত্যকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার নতুন ঘরে, তার স্বামীর ঘরে প্রবেশ করল। মহেন্দ্রবাবু তার পেছনে পেছনে ঘরে ঢুকলেন। ঘরের দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।
অনির্বাণ সেই বিশাল, সুসজ্জিত হলঘরে একা দাঁড়িয়ে রইল। এক ছায়ামূর্তি। এক পরাজিত রাজা, তার নিজের রাজ্যের এক কোণে নির্বাসিত। সে তার কর্তব্য পালন করেছে। সে তার নতুন ভূমিকা মেনে নিয়েছে। চৌধুরী বংশের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে, আর সেই অধ্যায়ের প্রথম পাতায়, তার নামটা লেখা আছে এক ফুটনোট হিসেবে।