অধ্যায় ৩৬: বাবা না দাদু?
নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফেরার পর দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেছে। আদিত্য, চৌধুরী বংশের নতুন উত্তরাধিকারী, এখন সকলের চোখের মণি। তার ছোট ছোট হাত-পা নাড়ানো, তার আধো-আধো শব্দ, তার খিলখিল হাসি—সবকিছুই ফ্ল্যাটের সেই পুরনো, ভারী পরিবেশটাকে বদলে দিয়েছে।
মালতী দেবী এখন অনেকটাই সুস্থ। তার সমস্ত জগৎ এখন তার নাতিকে ঘিরে। অনির্বাণও তার অফিসের জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে ছেলের জন্য খেলনা কেনে, তাকে কোলে নেওয়ার জন্য উসখুস করে। সে একজন নিখুঁত, সুখী বাবার অভিনয়টা চালিয়ে যাচ্ছে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।
আর রিয়া, সে এখন এক নতুন মানুষ। তার চোখে-মুখে এক অদ্ভুত তৃপ্তি, এক গভীর শান্তি। মাতৃত্ব তাকে সম্পূর্ণ করেছে। কিন্তু তার এই পরিপূর্ণতার আসল উৎস অন্য কোথাও।
সেদিন দুপুরে, ফ্ল্যাটটা শান্ত। মালতী দেবী তার ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছেন, আর অনির্বাণ অফিসে। রিয়া আদিত্যকে নিয়ে মহেন্দ্রবাবুর ঘরে প্রবেশ করল। এই ঘরটা এখন তার কাছে এক মন্দিরের মতো। তার ভালোবাসার, তার তৃপ্তির, তার গোপন পৃথিবীর কেন্দ্র।
মহেন্দ্রবাবু খাটে আধশোয়া হয়ে একটা বই পড়ছিলেন। রিয়াকে আর আদিত্যকে দেখে তিনি বইটা পাশে রেখে উঠে বসলেন। তার চোখে ফুটে উঠল এক গভীর, স্নেহমাখা হাসি। রিয়া আদিত্যকে তার কোলে দিল। "দেখো, তোমার ছেলে কেমন তাকিয়ে আছে তোমার দিকে," রিয়া মহেন্দ্রবাবুর পাশে বসতে বসতে বলল।
মহেন্দ্রবাবু আদিত্যর নরম তুলতুলে গালে আলতো করে চুমু খেলেন। তার শক্ত, খসখসে আঙুল দিয়ে তিনি আদিত্যর ছোট ছোট হাতগুলো ধরলেন। তার বুকের ভেতরটা এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে গেল। এই তার রক্ত, তার অংশ, তার উত্তরাধিকারী। কিন্তু সমাজ, সংসার, সম্পর্কের জটিলতায় তাকে আজ এই শিশুটির 'দাদু' হিসেবে পরিচয় দিতে হবে।
"বড় হয়ে ও যখন কথা বলতে শিখবে, তখন তোমাকে কী বলে ডাকবে গো?" রিয়া দুষ্টুমি ভরা চোখে তার প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। তার গলার স্বরটা ছিল আদুরে, আবদারের।
মহেন্দ্রবাবু হাসলেন। "কেন? আর কী বলে ডাকবে? 'দাদু' বলে ডাকবে।"
রিয়া তার কাঁধে মাথা রেখে বলল, "কিন্তু তুমি তো ওর দাদু নও। তুমি তো ওর বাবা। তাহলে ও তোমাকে 'বাবা' বলে ডাকবে না কেন?" এই কথাটায় মহেন্দ্রবাবু চমকে উঠলেন। তিনি রিয়ার মুখের দিকে তাকালেন। রিয়ার চোখে মুখে কোনো দ্বিধা নেই, আছে শুধু এক সরল, ভালোবাসার দাবি। "ছিঃ রিয়া, কেউ শুনে ফেললে কী ভাববে?" মহেন্দ্রবাবু নিচু গলায় বললেন, কিন্তু তার গলার স্বরে শাসনের থেকে বেশি ছিল স্নেহ।
"শুনলে শুনবে," রিয়া আরও ঘেঁষে বসল তার দিকে। "আমি তো কোনো অন্যায় বলিনি। তুমিই তো ওর জন্মদাতা। অনির্বাণ তো শুধু সমাজের চোখে ওর বাবা। কিন্তু আসল সত্যিটা তো আমরা জানি।" সে আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বলল, "কী রে বাবা, তুই তোর বাবাকে 'বাবা' বলেই তো ডাকবি, তাই না?" আদিত্য খিলখিল করে হেসে উঠল, যেন সে তার মায়ের সব কথা বুঝতে পেরেছে।
মহেন্দ্রবাবু রিয়াকে নিজের দিকে আরও টেনে নিলেন। তার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, "তুই একটা পাগলি।" "হ্যাঁ, আমি পাগলি। তোমার ভালোবাসায় পাগলি," রিয়া তার চওড়া বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল। "আমার খুব হিংসা হয় জানো তো। আদিত্য তোমাকে 'বাবা' বলে ডাকার অধিকার পাবে না। ওকেও অনির্বাণের মতোই সমাজের সামনে অভিনয় করে যেতে হবে।"
"এটাই তো আমাদের নিয়তি, রিয়া," মহেন্দ্রবাবু এক গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললেন। "আমরা যে পথে হেঁটেছি, সেখানে এটাই হওয়ার ছিল। কিন্তু মনে রাখিস, ও সারাজীবন আমার আশীর্বাদ পাবে। আমি ওর দাদু হই বা বাবা, আমি সবসময় ওর পাশে থাকব।"
"আমি জানি," রিয়া মহেন্দ্রবাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল। "কিন্তু আমার মন মানে না। মাঝে মাঝে মনে হয়, সব ছেড়ে দিয়ে, এই সমাজ, এই সংসার—সবকিছু পেছনে ফেলে দিয়ে, তোমাকে আর আদিত্যকে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে শুধু আমরা তিনজন থাকব। তুমি, আমি, আর আমাদের ছেলে।"
রিয়ার এই কথায় মহেন্দ্রবাবুর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। তিনিও তো এটাই চান। কিন্তু তিনি জানেন, তা সম্ভব নয়। তারা এক সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ। তিনি কিছু না বলে রিয়াকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আদিত্য তখন তার দাদু/বাবার কোলে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। এই দৃশ্যটা ছিল এক অদ্ভুত সুন্দর, কিন্তু করুণ ছবি। এক নিষিদ্ধ সম্পর্কের ফসল, এক গোপন সত্য, যা কোনোদিন সমাজের সামনে আসবে না।
তাদের এই আবেগঘন মুহূর্তটা ভেঙে গেল ফোনের শব্দে। মহেন্দ্রবাবুর ফোন। গ্রামের ম্যানেজার ফোন করেছে।
অধ্যায় ৩৭: ফেরার ডাক ও নতুন সংকট
ফোনটা রাখার পর মহেন্দ্রবাবুর মুখটা গম্ভীর হয়ে গেল। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। "কী হয়েছে?" রিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল। "গ্রাম থেকে ফোন ছিল। জমির একটা পুরনো মামলা নিয়ে আবার ঝামেলা শুরু হয়েছে। আমাকে একবার যেতে হবে।"
"কবে যাবে?" "যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ম্যানেজার একা সামলাতে পারছে না।"
এই কথা শোনার সাথে সাথে রিয়ার বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠল। "যেতে হবে? মানে? তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে?" তার গলাটা ধরে এল।
"আরে না, পাগলি," মহেন্দ্রবাবু তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন। "কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসব। কাজটা মিটিয়েই চলে আসব।"
কিন্তু পরের দিন সকালে, পরিস্থিতি আরও জটিল হলো। মালতী দেবী খবরটা শুনে বললেন, "তুমিও যখন যাচ্ছ, তখন আমিও তোমার সাথে যাব। এখানে আর আমার ভালো লাগছে না। আমার শরীর এখন অনেকটাই সুস্থ। নিজের বাড়ি ছেড়ে, নিজের সংসার ছেড়ে আর কতদিন এখানে পড়ে থাকব? নাতিকে দেখলাম, বংশের প্রদীপ জ্বলল, আমার শান্তি। এবার আমি বাড়ি ফিরতে চাই।"
মহেন্দ্রবাবু উভয় সংকটে পড়লেন। তিনি মালতী দেবীকে ফেরাতে পারলেন না। তার কথাটাও ঠিক। এক বছরের বেশি সময় ধরে তারা এখানে আছেন।
খাবার টেবিলে মহেন্দ্রবাবু যখন ঘোষণা করলেন যে তারা দুজনেই আগামী সপ্তাহে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন, তখন ফ্ল্যাটের ওপর যেন বাজ পড়ল। অনির্বাণ কিছু বলল না। সে নীরবে খেয়ে গেল। তার যাওয়া বা না যাওয়ায় তার কিছু যায় আসে না।
কিন্তু রিয়ার পৃথিবীটা যেন দুলে উঠল। সে ভেবেছিল, মহেন্দ্রবাবু কয়েকদিনের জন্য যাচ্ছেন। কিন্তু এখন তারা পাকাপাকিভাবে ফিরে যাচ্ছেন? তার মানে, এই ঘরটা আবার খালি হয়ে যাবে। তার জীবনের এই নতুন আনন্দ, এই নতুন ভালোবাসা, সব কি শেষ হয়ে যাবে? সে আবার সেই পুরনো, একা, অতৃপ্ত জীবনে ফিরে যাবে?
"মা, আপনি আরও কিছুদিন থেকে যান। আপনার শরীরটা এখনও পুরোপুরি সারেনি," রিয়া শেষ চেষ্টা করল। "না বৌমা। নিজের বাড়ির মতো শান্তি আর কোথাও নেই। তোরা আসবি মাঝে মাঝে। নাতিকে নিয়ে আসবি। আমরাও আসব। কিন্তু এবার আমাদের ফেরা দরকার।"
রিয়ার আর কিছু বলার ছিল না। সে বুঝতে পারছিল, তার সুখের দিন শেষ হতে চলেছে। তার রাজা তাকে ছেড়ে তার নিজের রাজ্যে ফিরে যাচ্ছে। আর সে, রানী হয়েও, এই শূন্য প্রাসাদে একা পড়ে থাকবে।
রাতে, যখন আদিত্য ঘুমিয়ে পড়েছে, রিয়া মহেন্দ্রবাবুর ঘরে গেল। "তুমি সত্যি চলে যাচ্ছ?" তার চোখে জল। মহেন্দ্রবাবু রিয়াকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। "আমাকে যেতে হবে, রিয়া। আমার দায়িত্ব আছে, আমার কর্তব্য আছে।" "আর আমার প্রতি তোমার কোনো দায়িত্ব নেই? আমাদের ছেলের প্রতি তোমার কোনো কর্তব্য নেই?" রিয়া কান্নায় ভেঙে পড়ল।
"আছে। আর সেই জন্যই আমাকে যেতে হবে," মহেন্দ্রবাবু তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললেন। "আমি যদি এখানে থাকি, তাহলে এই গোপন কথাটা কোনোদিন গোপন থাকবে না। অনির্বাণের জন্যও এটা খুব অপমানের। আমি চাই, ও ওর ছেলের বাবা হিসেবে নিজের পরিচয়টা খুঁজে পাক।"
"ও কোনোদিনও পারবে না," রিয়া ঘৃণার সাথে বলল। "ও একটা কাপুরুষ।" "জানি। কিন্তু চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।"
"তাহলে আমার কী হবে? আমি তোমাকে ছাড়া কীভাবে থাকব?" "আমি আবার আসব। যখনই সুযোগ পাব, চলে আসব। আর তুইও আদিত্যকে নিয়ে গ্রামে যাবি। আমাদের এই সম্পর্কটা শেষ হয়ে যায়নি, রিয়া। শুধু তার রূপটা একটু বদলে যাবে।"
মহেন্দ্রবাবু রিয়াকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু রিয়ার মন মানছিল না। তার মনে হচ্ছিল, তার জীবনের একমাত্র আলোর উৎসটিও যেন নিভে যেতে চলেছে। সে মহেন্দ্রবাবুকে জড়িয়ে ধরে সারারাত ধরে কাঁদল। আর মহেন্দ্রবাবু, এক শক্তিশালী জমিদার হয়েও, তার এই নতুন পাওয়া ভালোবাসা, তার সন্তানকে ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণায়, নীরবে চোখের জল ফেললেন। তাদের এই নিষিদ্ধ জাগরণের গল্পে এক নতুন, বিরহের অধ্যায় শুরু হতে চলেছিল।
অধ্যায় ৩৮: গ্রামের স্মৃতি, ক্ষমতা ও শূন্যতা
বর্ধমানের সেই বিশাল চৌধুরী বাড়িতে ফিরে এসে মহেন্দ্রবাবু বুঝতে পারছিলেন, তিনি তার শরীরটাকেই শুধু কলকাতা থেকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন, তার মনটা পড়ে আছে বালিগঞ্জের সেই আটতলার ফ্ল্যাটে।
এখানে তিনি জমিদার। তার কথায় গ্রামের মানুষ ওঠে-বসে। তার নামে বিঘার পর বিঘা জমি, বিশাল আমবাগান, মাছের ভেড়ি—সবকিছুই আগের মতো আছে। তার ক্ষমতা, তার প্রতিপত্তি, সবই অটুট। কিন্তু কোনো কিছুতেই তিনি আর আগের মতো আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। এই বিশাল, পুরনো বাড়িটা তার কাছে এখন এক বিরাট শূন্যতার মতো মনে হয়। প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি বারান্দায় তিনি যেন রিয়ার ছায়া দেখতে পান। তিনি যেন শুনতে পান আদিত্যর খিলখিল হাসি।
দিনের বেলা তিনি নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখেন। জমির হিসাব, মামলার ঝামেলা, গ্রামের মানুষের সালিশি—সবকিছুতেই তিনি মন দেন। কিন্তু রাত নামলেই তার ভেতরের একাকীত্বটা তাকে গ্রাস করে।
মালতী দেবী এখন অনেকটাই সুস্থ। তিনি তার নিজের সংসারে ফিরে এসে খুব খুশি। তিনি আবার তার পুরনো কর্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তার জগৎ এখন এই বাড়ি, এই সংসার, আর তার পূজার ঘরকে ঘিরে। মহেন্দ্রবাবু তার স্ত্রীর দিকে তাকান। এই মহিলাটি তার জীবনের ধ্রুবতারা। তার যৌবন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত, মালতী দেবী তার পাশে থেকেছেন। তার ক্ষমতার উৎস, তার সামাজিক সম্মানের ভিত্তিই হলেন মালতী। মহেন্দ্রবাবু তার স্ত্রীকে গভীরভাবে ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু এই ভালোবাসায় কোনো উত্তাপ নেই, কোনো শারীরিক খিদে নেই। এটা একটা অভ্যাসের মতো, একটা কর্তব্যের মতো।
রাতে, যখন তারা একই বিছানায় শোন, তখন তাদের মধ্যে যেন এক অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে থাকে। মহেন্দ্রবাবুর শরীরটা চায় রিয়ার সেই নরম, উষ্ণ শরীরটাকে জড়িয়ে ধরতে, তার ঘ্রাণ নিতে। তার মনটা ছটফট করে রিয়ার সাথে কথা বলার জন্য, তার গলা শোনার জন্য। কিন্তু তিনি পারেন না। তার পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রী, তার প্রতি তার দায়িত্ব, তার বিবেক—সবকিছু তাকে বাধা দেয়। তিনি বুঝতে পারেন, তিনি রিয়ার প্রেমে আসক্ত হয়ে পড়েছেন, কিন্তু তার জীবনের শিকড়টা মালতী দেবীর সাথে, এই গ্রামের মাটির সাথে এতটাই গভীরে যে, তা ছিঁড়ে ফেলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তিনি তার ক্ষমতা আর কর্তব্যের জালে নিজেই বন্দী হয়ে পড়েছেন।
অধ্যায় ৩৯: প্রায়শ্চিত্ত ও নতুন প্রচেষ্টা
মহেন্দ্রবাবু আর মালতী দেবী চলে যাওয়ার পর বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটটা আবার তার পুরনো রূপে ফিরে গেছে। শান্ত, নীরব, প্রাণহীন। কিন্তু এই নীরবতার অর্থ এখন বদলে গেছে।
অনির্বাণের জীবনে এক বিশাল ঝড় বয়ে গেছে। তার বাবা-মায়ের সামনে, বিশেষ করে তার বাবার সামনে তার পুরুষত্বের যে চূড়ান্ত অপমান হয়েছে, তা তাকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছে। খাটের নিচে লুকিয়ে থেকে দেখা সেই দৃশ্যগুলো তার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
কিন্তু তার বাবার সেই তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি, সেই নীরব dismissal, অনির্বাণের voyeuristic সত্তাটাকেও হত্যা করেছে। তার আর লুকিয়ে দেখার ইচ্ছে করে না। সেই বিকৃত আনন্দটা এখন এক গভীর আত্মগ্লানিতে পরিণত হয়েছে।
সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে তার নিজেরই ঘৃণা হয়। সে কী করেছে? নিজের দুর্বলতার কারণে সে তার স্ত্রীকে ঠেলে দিয়েছে তার বাবার বিছানায়। সে শুধু একজন অক্ষম স্বামীই নয়, সে একজন মেরুদণ্ডহীন পুত্রও বটে।
এই আত্মগ্লানি থেকেই হয়তো জন্ম নেয় এক নতুন প্রচেষ্টা। এক প্রায়শ্চিত্ত করার ইচ্ছা। সে ঠিক করে, সে তার জীবনটাকে আবার নতুন করে গোছানোর চেষ্টা করবে। সে তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে।
অনির্বাণ বদলে যেতে শুরু করে। সে এখন আর রাত করে বাড়ি ফেরে না। সে ঠিক সময়ে অফিস থেকে ফিরে আসে। বাড়ি ফেরার পথে সে রিয়ার জন্য তার পছন্দের রজনীগন্ধা ফুল নিয়ে আসে। সে রিয়ার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে। তার সারাদিন কেমন কাটল, অফিসের কথা—এইসব ছোট ছোট কথা দিয়ে সে তাদের মধ্যেকার বরফ গলানোর চেষ্টা করে।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে আদিত্যর ক্ষেত্রে। অনির্বাণ এখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা আদিত্যর সাথে সময় কাটায়। সে তাকে কোলে নেয়, তার সাথে খেলে, তাকে ঘুম পাড়ায়। সে জানে, আদিত্য তার রক্ত নয়। কিন্তু সে মনকে বোঝায়, এই ছেলেই তার পরিচয়। এই ছেলেই তার বাবা হওয়ার অপূর্ণ সাধ পূরণ করবে। অনির্বাণের এই পরিবর্তনগুলো তার ভাঙা আত্মসম্মানকে জোড়া লাগানোর এক মরিয়া চেষ্টা। সে রিয়াকে দেখাতে চায়, সে হয়তো একজন অক্ষম পুরুষ, কিন্তু সে একজন ভালো স্বামী, একজন ভালো বাবা হওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
অধ্যায় ৪০: দুই নৌকায় পা ও হৃদয়ের দোটানা
অনির্বাণের এই পরিবর্তন রিয়ার চোখ এড়ায় না। সে অবাক হয়। যে মানুষটা এতদিন ধরে এক ছায়ার মতো বেঁচে ছিল, তার মধ্যে এই আকস্মিক পরিবর্তন রিয়াকে এক নতুন দ্বিধায় ফেলে দেয়।
অনির্বাণ যখন তার জন্য ফুল নিয়ে আসে, বা তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে, তখন রিয়ার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তার মনে পড়ে যায় তাদের ভালোবাসার সেই পুরনো দিনগুলোর কথা। এই তো সেই অনির্বাণ, যাকে সে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। তার এই আনাড়ি, কিন্তু আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখে রিয়ার মনে তার জন্য এক ধরনের করুণা, এক ধরনের মায়া জন্মায়। ব্যবহারকারী যেমনটি বলেছিলেন, সে তার স্বামীকে ভালোবাসে, বা হয়তো একসময় ভালোবাসত। সেই পুরনো ভালোবাসাটা যেন আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সে অনির্বাণের দিকে তাকালে তার প্রতি কোনো ঘৃণা অনুভব করে না, করে এক গভীর সহানুভূতি।
কিন্তু রাত নামলেই তার জগৎটা বদলে যায়। তার শরীরটা চায় মহেন্দ্রবাবুর সেই শক্তিশালী স্পর্শ। তার কানটা যেন মহেন্দ্রবাবুর সেই গভীর, কামার্ত গলার স্বর শোনার জন্য অপেক্ষা করে। তারা এখন রোজ রাতে ফোনে কথা বলে। মহেন্দ্রবাবুর গলার স্বর শুনলেই রিয়ার শরীরটা উত্তেজনায় কাঁপতে শুরু করে। "খুব মনে পড়ছে তোকে, রিয়া," মহেন্দ্রবাবু বলেন। "আমারও," রিয়া ফিসফিস করে উত্তর দেয়। "তোমার ওই মোটা বাঁড়াটার জন্য আমার গুদটা κάθε দিন কাঁদে।" ফোনের দু-প্রান্তে দুটো অতৃপ্ত শরীর ছটফট করে।
রিয়া এখন এক ভয়ঙ্কর দোটানার মধ্যে। দিনের বেলা সে অনির্বাণের ভালো স্ত্রী হওয়ার অভিনয় করে। অনির্বাণ যখন তার হাত ধরে, বা তাকে আলতো করে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করে, তখন সে বাধা দেয় না। সে নিজেকে সঁপে দেয়। কারণ সে জানে, মানুষটা চেষ্টা করছে। তাকে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুর সে হতে পারে না।
কিন্তু অনির্বাণের স্পর্শে তার শরীর সাড়া দেয় না। অনির্বাণ যখন তাকে আদর করে, তখন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মহেন্দ্রবাবুর মুখ। অনির্বাণের দুর্বল, দ্রুতগতির মিলনের সময় সে চোখ বন্ধ করে কল্পনা করে, যেন মহেন্দ্রবাবুই তাকে তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চুদছেন।
এই দ্বৈত জীবন রিয়াকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। সে অনুভব করে, সে দুটো নৌকায় পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক নৌকায় আছে তার পুরনো ভালোবাসা, তার সংসার, তার দায়িত্ব। আর অন্য নৌকায় আছে তার নতুন প্রেম, তার শারীরিক তৃপ্তি, তার জীবনের পরিপূর্ণতা। সে জানে, এই দুটো নৌকা কোনোদিন এক ঘাটে ভিড়বে না। তাকে যেকোনো একটাকে বেছে নিতে হবে। কিন্তু সে কোনটা বাছবে? তার শান্ত, নিরাপদ বর্তমান, নাকি তার উত্তাল, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ?
এক রাতে, অনির্বাণ তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করার পর, যখন সে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে, রিয়া তার পাশে শুয়ে শুয়ে কাঁদছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে একই সাথে দুজন মানুষকে ঠকাচ্ছে। অনির্বাণকে, এবং মহেন্দ্রবাবুকে। আর সবচেয়ে বেশি ঠকাচ্ছে সে নিজেকে। এই জটিল সম্পর্কের জাল থেকে সে কীভাবে বেরোবে, তার কোনো পথ সে খুঁজে পাচ্ছিল না। তার নিষিদ্ধ জাগরণের গল্প এক নতুন, আরও যন্ত্রণাদায়ক সংকটের মুখে এসে দাঁড়িয়েছিল।